page-1
খ্যাতিমান কবিদের কবিতা
বিচার
- সুকুমার রায় ইঁদুর দেখে মাম্দো কুকুর বল্লে তেড়ে হেঁকে- "বলব কি আর, বড়ই খুশি হলেম তোরে দেখে। আজকে আমার কাজ কিছু নেই, সময় আছে মেলা, আয় না খেলি দুইজনাতে মোকদ্দমা খেলা । তুই হবি চোর তোর নামেতে করব নালিশ রুজু"- "জজ্ কে হবে?" বল্লে ইঁদুর ,বিষম ভয়ে জুজু, "কোথায় উকিল প্যায়দা পুলিশ , বিচার কিসে হবে?" মাম্দো বলে "তাও জানিসনে ? শোন বলে দেই তবে! আমিই হব উকিল হাকিম , আমিই হব জুরি, কান ধরে তোর বলব ব্যাটা, ফের করেছিস চুরি? সটান দেব ফাসির হুকুম অমনি একেবারে- বুঝবি তখন চোর বাছাধন বিচার বলে কারে।" নারী
- কাজী নজরুল ইসলাম
সাম্যের গান গাই - আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই। বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী। নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান? তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান। অথবা পাপ যে - শয়তান যে - নর নহে নারী নহে, ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে। এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল, নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল। তাজমহলের পাথর দেখেছে, দেখিয়াছ তার প্রাণ? অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান। জ্ঞানের লক্ষ্ণী, গানের লক্ষ্ণী, শস্য-লক্ষ্ণী নারী, সুষমা-লক্ষ্ণী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’। পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ, কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ। দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস, নিশীথে হয়েছে বধু, পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে, নারী যোগায়েছে মধু। শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল, নারী সে মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল। নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে’ ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালি ধানের শীষে। স্বর্ণ-রৌপ্যভার নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হয়েছে অলঙ্কার। নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ, যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান। নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’ জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে। জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান মাতা ভগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান। কোন্ রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে, কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে। কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি’ কত বোন দিল সেবা, বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা? কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্ণী নারী। রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রানী, রানির দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি। পুরুষ হৃদয়হীন, মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ। ধরায় যাঁদের যশ ধরে না ক’ অমর মহামানব, বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব। খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা। লব-কুশে বনে তাজিয়াছে রাম, পালন করেছে সীতা। নারী সে শিখাল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া, দীপ্ত নয়নে পরাল কাজল বেদনার ঘন ছায়া। অদ্ভূতরূপে পুরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ, বুকে করে তারে চুমিল যে, তারে করিল সে অবরোধ। তিনি নর-অবতার - পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার। পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর - নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর। সে যুগ হয়েছে বাসি, যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী। বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি, কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি’। নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে! যুগের ধর্ম এই- পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই। শোনো মর্ত্যের জীব! অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব! স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্ সে অত্যাচারী? আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা, আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা! চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল, মাথার ঘোম্টা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল! যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ, দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যত আভরণ! ধরার দুলালী মেয়ে, ফির না তো আর গিরিদরীবনে পাখী-সনে গান গেয়ে। কখন আসিল ‘প্নুটো’ যমরাজা নিশীথ-পাখায় উড়ে, ধরিয়া তোমায় পুরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে! সেই সে আদিম বন্ধন তব, সেই হতে আছ মরি’ মরণের পুরে; নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী। ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মতো আয় মা পাতাল ফুঁড়ি! আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি! পুরুষ-যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে! এতদনি শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে, যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে। সেদিন সুদূর নয়- যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়! প্রার্থনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি, যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে উচ্ছ্বাসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায় অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়, যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি- পৌরুষেরে করে নি শতধা, নিত্য যেথা তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা, নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ, ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।। দুই বিঘা জমি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে। বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।' কহিলাম আমি, 'তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই - চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই। শুনি রাজা কহে, 'বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা, পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা - ওটা দিতে হবে।' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি সজল চক্ষে, 'করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি। সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া, দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!' আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে, কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, 'আচ্ছা, সে দেখা যাবে।' পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে - করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে। এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি। মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে, তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে। সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য - কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য। ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি। হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো, একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।। নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি! গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি। অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি - ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি। পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ - স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ। বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে। দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে - কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে, রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।। ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি, যখনি যাহার তখনি তাহার - এই কি জননী তুমি! সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা! আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ - পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ! আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন, তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন! ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন - কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন! কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি। যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী - হলে দাসী।। বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি - প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি! বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা, একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা। সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম, অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম। সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন - ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন। সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে, দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে। ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা। স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।। হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী। ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি। কহিলাম তবে, 'আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব - দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।' চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ; বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ - শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, 'মারিয়া করিব খুন।' বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ। আমি কহিলাম, 'শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!' বাবু কহে হেসে, 'বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!' আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে - তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।। কাজলা দিদি - যতীন্দ্রমোহন বাগচী বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই? পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই- মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই? সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;- দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো? খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন, ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো? আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো? বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে? কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে! দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমিও যদি লুকাই গিয়ে তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে, আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে। ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল, মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল। ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে, উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,- দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল! বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই- এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই? লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে’ ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই? কবর - জসীমউদ্দীন এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ, পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক। এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা, সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা! সোনালি ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি লাঙল লইয়া খেতে ছুটিলাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি। যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত। এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে ছোট-খাট তার হাসি ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে। বাপের বাড়িতে যাইবার কাল কহিত ধরিয়া পা আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ। শাপলার হাটে তরমুজ বেচি পয়সা করি দেড়ী, পুঁতির মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি। দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে, সন্ধাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে! হেস না হেস না শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে, দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে! নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এতদিন পরে এলে, পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে। আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়, কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়! হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়, আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়। তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি। শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি, গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি। এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে, গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে। মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক, আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ। এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা, কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না। সেই ফালগুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি, বা-জান, আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি। ঘরের মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম বাছা শোও, সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কী জানিত কেউ? গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে, তুমি যে কহিলা বা-জানরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে? তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে, সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে! তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জঢ়ায়ে ধরি, তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিতে সারা দিনমান ভরি। গাছের পাতার সেই বেদনায় বুনো পথে যেতো ঝরে, ফালগুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো-মাঠখানি ভরে। পথ দিয়া যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ, চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক। আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি, হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি। গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা, চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ। ঊদাসিনী সেই পল্লী-বালার নয়নের জল বুঝি, কবর দেশের আন্ধারে ঘরে পথ পেয়েছিল খুজি। তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ, হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ। মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, বাছারে যাই, বড় ব্যথা র’ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই; দুলাল আমার, যাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে, কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে। ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গন্ড ভিজায়ে নয়নজলে, কী জানি আশিস করে গেল তোরে মরণব্যথার ছলে। ক্ষণপরে মোরে ডাকিয়া কহিল আমার কবর গায় স্বামীর মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়। সেই যে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে, পরাণের ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। জোড়মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরুছায়, গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়। জোনকিমেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো, ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো। হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, রহমান খোদা! আয়; ভেস্ত নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়! এখানে তোর বুজির কবর, পরীর মতন মেয়ে, বিয়ে দিয়েছিনু কাজিদের বাড়ি বনিয়াদি ঘর পেয়ে। এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে, হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে। খবরের পর খবর পাঠাত, দাদু যেন কাল এসে দুদিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে। শ্বশুর তাহার কশাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে। সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি, কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি। বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন, কে জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণবীণ! কী জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে, এইখানে তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে। ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেহ ভালো, কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো। বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন, পাতায় পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ। হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু, আয় খোদা! দয়াময়। আমার বুজীর তরেতে যেন গো বেস্ত নসিব হয়। হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু, সাত বছরের মেয়ে, রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে। ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা, অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা! ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে, তোমার দাদির ছবিখানি মোর হদয়ে উঠিত ছেয়ে। বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা, রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা। একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে, ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে। সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে। কী জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে। আপন হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি, দাদু! ধরধর বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি। এইখানে এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু, কথা কস নাকো, জাগিয়া উটিবে ঘুমভোলা মোর যাদু। আস্তে আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে, ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিয়ে ঘন আবিরের রাগে, অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে। মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সুকরুণ সুরে, মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে। জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান। ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যুব্যথিত প্রাণ। দুর্ভাগা দেশ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে, সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে। বিধাতার রুদ্ররোষে দুর্ভিক্ষের-দ্বারে বসে ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে। চরণে দলিত হয়ে ধূলায় সে যায় বয়ে - সেই নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ। অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান। যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান। অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার, মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার। তবু নত করি আঁখি দেখিবার পাও না কি নেমেছে ধূলার তলে হীনপতিতের ভগবান। অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান। দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে - অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে। সবারে না যদি ডাকো, এখনো সরিয়া থাকো, আপনারে বেঁধে রাখো চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান - মৃত্যু-মাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান। বুঝিয়ে বলা - সুকুমার রায় ও শ্যামাদাস! আয়তো দেখি, বোস তো দেখি এখেনে, সেই কথাটা বুঝিয়ে দেব পাঁচ মিনিটে, দেখে নে৷ জ্বর হয়েছে? মিথ্যে কথা! ওসব তোদের চালাকি— এই যে বাবা চেঁচাচ্ছিলি, শুনতে পাইনি? কালা কি? মামার ব্যামো? বদ্যি ডাকবি? ডাকিস না হয় বিকেলে না হয় আমি বাৎলে দেব বাঁচবে মামা কি খেলে! আজকে তোকে সেই কথাটা বোঝাবই বোঝাব— না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল মেরে গোঁজাব৷ কোন্ কথাটা? তাও ভুলেছিস্? ছেড়ে দিছিস্ হাওয়াতে? কি বলছিলেম পরশু রাতে বিষ্টু বোসের দাওয়াতে? ভুলিসনি তো বেশ করেছিস্, আবার শুনলে ক্ষেতি কি? বড় যে তুই পালিয়ে বেড়াস্, মাড়াস্নে যে এদিক্ই! বলছি দাঁড়া, ব্যস্ত কেন? বোস্ তাহলে নিচুতেই— আজকালের এই ছোক্রাগুলোর তর্ সয়না কিছুতেই৷ আবার দেখ! বসলি কেন? বইগুলো আন্ নামিয়ে— তুই থাক্তে মুটের বোঝা বইতে যাব আমি এ? সাবধানে আন্, ধরছি দাঁড়া–সেই আমাকেই ঘামালি, এই খেয়ছে! কোন্ আক্কেলে শব্দকোষটা নামালি? ঢের হয়েছে! আয় দেখি তুই বোস্ তো দেখি এদিকে— ওরে গোপাল গোটাকয়েক পান দিতে বল্ খেঁদিকে৷ বলছিলাম কি, বস্তুপিণ্ড সূক্ষ্ম হতে স্থূলেতে, অর্থাৎ কিনা লাগ্ছে ঠেলা পঞ্চভূতের মূলেতে— গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কি ক'রে, রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে৷ অর্থাৎ কিনা, এই মনে কর্, রোদ পড়েছে ঘাসেতে, এই মনে কর্, চাঁদের আলো পড়লো তারি পাশেতে— আবার দেখ! এরই মধ্যে হাই তোলবার মানে কি? আকাশপানে তাকাস্ খালি, যাচ্ছে কথা কানে কি? কি বল্লি তুই? এ সব শুধু আবোল তাবোল বকুনি? বুঝতে হলে মগজ লাগে, বলেছিলাম তখুনি৷ মগজভরা গোবর তোদের হচ্ছে ঘুঁটে শুকিয়ে, যায় কি দেওয়া কোন কথা তার ভিতেরে ঢুকিয়ে?— ও শ্যামাদাস! উঠলি কেন? কেবল যে চাস্ পালাতে! না শুনবি তো মিথ্যে সবাই আসিস্ কেন জ্বালাতে? তত্ত্বকথা যায় না কানে যতই মরি চেঁচিয়ে— ইচ্ছে করে ডান্পিটেদের কান ম'লে দি পেঁচিয়ে৷ ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা। রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে আজকে যে যা বলে বলুক তোরে, সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা। আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা। খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়; আর তো কিছুই নড়ে না রে ওদের ঘরে, ওদের ঘরের দাওয়ায়। ওই যে প্রবীণ, ওই যে পরম পাকা, চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা, ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায়। আয় জীবন্ত, আয় রে আমার কাঁচা। বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ, দেখে না যে বাণ ডেকেছে জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ। চলতে ওরা চায় না মাটির ছেলে মাটির ‘পরে চরণ ফেলে ফেলে, আছে অচল আসনখানা মেলে যে যার আপন উচ্চ বাঁশের মাচায়, আয় অশান্ত, আয় রে আমার কাঁচা। তোরে হেথায় করবে সবাই মানা। হঠাৎ আলো দেখবে যখন ভাববে এ কী বিষম কাণ্ডখানা। সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে, শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে, সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়। আয় প্রচণ্ড, আয় রে আমার কাঁচা। শিকল-দেবীর ওই যে পূজাবেদী চিরকাল কি রইবে খাড়া। পাগলামি তুই আয় রে দুয়ার ভেদি। ঝড়ের মাতন, বিজয়-কেতন নেড়ে অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে, ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে ভুলগুলো সব আন্ রে বাছা-বাছা। আয় প্রমত্ত, আয় রে আমার কাঁচা। আন্ রে টেনে বাঁধা-পথের শেষে। বিবাগী কর্ অবাধপানে, পথ কেটে যাই অজানাদের দেশে। আপদ আছে, জানি অঘাত আছে, তাই জেনে তো বক্ষে পরান নাচে, ঘুচিয়ে দে ভাই পুঁথি-পোড়োর কাছে পথে চলার বিধিবিধান যাচা। আয় প্রমুক্ত, আয় রে আমার কাঁচা। চিরযুবা তুই যে চিরজীবী, জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি। সবুজ নেশায় ভোর করেছি ধরা, ঝড়ের মেঘে তোরি তড়িৎ ভরা, বসন্তেরে পরাস আকুল-করা আপন গলার বকুল-মাল্যগাছা, আয় রে অমর, আয় রে আমার কাঁচা। |
বনলতা সেন
- জীবনানন্দ দাশ হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন । চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?' পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল; পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল; সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। পুরাতন ভৃত্য
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূতের মতন চেহারা যেমন, নির্বোধ অতি ঘোর— যা‐কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, “কেষ্টা বেটাই চোর।” উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত, শুনেও শোনে না কানে। যত পায় বেত না পায় বেতন, তবু না চেতন মানে। বড়ো প্রয়োজন, ডাকি প্রাণপণ চীৎকার করি “কেষ্টা”— যত করি তাড়া নাহি পাই সাড়া, খুঁজে ফিরি সারা দেশটা। তিনখানা দিলে একখানা রাখে, বাকি কোথা নাহি জানে; একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে তিনখানা করে আনে। যেখানে সেখানে দিবসে দুপুরে নিদ্রাটি আছে সাধা; মহাকলরবে গালি দেই যবে “পাজি হতভাগা গাধা”— দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে, দেখে জ্বলে যায় পিত্ত। তবু মায়া তার ত্যাগ করা ভার— বড়ো পুরাতন ভৃত্য। ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি বলে, “আর পারি নাকো, রহিল তোমার এ ঘর‐দুয়ার, কেষ্টারে লয়ে থাকো। না মানে শাসন বসন বাসন অশন আসন যত কোথায় কী গেল, শুধু টাকাগুলো যেতেছে জলের মতো। গেলে সে বাজার সারা দিনে আর দেখা পাওয়া তার ভার— করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি ভৃত্য মেলে না আর!” শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে, আনি তার টিকি ধরে; বলি তারে, “পাজি, বেরো তুই আজই, দূর করে দিনু তোরে।” ধীরে চলে যায়, ভাবি গেল দায়; পরদিনে উঠে দেখি, হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি— প্রসন্ন মুখ, নাহি কোনো দুখ, অতি অকাতর চিত্ত! ছাড়ালে না ছাড়ে, কী করিব তারে— মোর পুরাতন ভৃত্য! সে বছরে ফাঁকা পেনু কিছু টাকা করিয়া দালালগিরি। করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন বারেক আসিব ফিরি। পরিবার তায় সাথে যেতে চায়, বুঝায়ে বলিনু তারে— পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, নহিলে খরচ বাড়ে। লয়ে রশারশি করি কষাকষি পোঁটলাপুঁটলি বাঁধি বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে গৃহিণী কহিল কাঁদি, “পরদেশে গিয়ে কেষ্টারে নিয়ে কষ্ট অনেক পাবে।” আমি কহিলাম, “আরে রাম রাম! নিবারণ সাথে যাবে।” রেলগাড়ি ধায়; হেরিলাম হায় নামিয়া বর্ধমানে— কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত, তামাক সাজিয়া আনে! স্পর্ধা তাহার হেনমতে আর কত বা সহিব নিত্য! যত তারে দুষি তবু হনু খুশি হেরি পুরাতন ভৃত্য! নামিনু শ্রীধামে— দক্ষিণে বামে পিছনে সমুখে যত লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা করিল কণ্ঠাগত। জন‐ছয়‐সাতে মিলি এক‐সাথে পরমবন্ধুভাবে করিলাম বাসা; মনে হল আশা, আরামে দিবস যাবে। কোথা ব্রজবালা কোথা বনমালা, কোথা বনমালী হরি! কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত! আমি বসন্তে মরি। বন্ধু যে যত স্বপ্নের মতো বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ; আমি একা ঘরে ব্যাধি‐খরশরে ভরিল সকল অঙ্গ। ডাকি নিশিদিন সকরুণ ক্ষীণ, “কেষ্ট আয় রে কাছে। এত দিনে শেষে আসিয়া বিদেষে প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে।” হেরি তার মুখ ভরে ওঠে বুক, সে যেন পরম বিত্ত— নিশিদিন ধরে দাঁড়ায়ে শিয়রে মোর পুরতন ভৃত্য। মুখে দেয় জল, শুধায় কুশল, শিরে দেয় মোর হাত; দাঁড়ায়ে নিঝুম, চোখে নাই ঘুম, মুখে নাই তার ভাত। বলে বার বার, “কর্তা, তোমার কোনো ভয় নাই, শুন— যাবে দেশে ফিরে, মাঠাকুরানীরে দেখিতে পাইবে পুন।” লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম; তাহারে ধরিল জ্বরে; নিল সে আমার কালব্যাধিভার আপনার দেহ‐’পরে। হয়ে জ্ঞানহীন কাটিল দু দিন, বন্ধ হইল নাড়ী; এতবার তারে গেনু ছাড়াবারে, এতদিনে গেল ছাড়ি। বহুদিন পরে আপনার ঘরে ফিরিনু সারিয়া তীর্থ; আজ সাথে নেই চিরসাথি সেই মোর পুরাতন ভৃত্য। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান! না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ। জাগিয়া উঠেছে প্রাণ, ওরে উথলি উঠেছে বারি, ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি। থর থর করি কাঁপিছে ভূধর, শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে, ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল গরজি উঠিছে দারুণ রোষে। হেথায় হোথায় পাগলের প্রায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায় - বাহিরেতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার। কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন, চারি দিকে তার বাঁধন কেন! ভাঙ্ রে হৃদয়, ভাঙ্ রে বাঁধন, সাধ্ রে আজিকে প্রাণের সাধন, লহরীর পরে লহরী তুলিয়া আঘাতের পরে আঘাত কর্। মাতিয়া যখন উঠেছে পরান কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ! উথলি যখন উঠেছে বাসনা জগতে তখন কিসের ডর! আমি ঢালিব করুণাধারা, আমি ভাঙিব পাষাণকারা, আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া আকুল পাগল-পারা। কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া, রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া, রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরান ঢালি। শিখর হইতে শিখরে ছুটিব, ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব, হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি। এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর, এত সুখ আছে, এত সাধ আছে - প্রাণ হয়ে আছে ভোর।। কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ - দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান। ওরে, চারি দিকে মোর এ কী কারাগার ঘোর - ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর্। ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি, এসেছে রবির কর। কুম্ড়োপটাশ - সুকুমার রায় (যদি) কুম্ড়োপটাশ নাচে— খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে; চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে; চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমূলার গাছে! (যদি) কুম্ড়োপটাশ কাঁদে— খবরদার! খবরদার! বসবে না কেউ ছাদে; উপুড় হয়ে মাচায় শুয়ে লেপ কম্বল কাঁধে; বেহাগ সুরে গাইবে খালি ‘রাধে কৃষ্ণ রাধে’! (যদি) কুম্ড়োপটাশ হাসে— থাকবে খাড়া একটি ঠ্যাঙে রান্নাঘরের পাশে; ঝাপ্সা গলায় ফার্সি কবে নিশ্বাসে ফিস্ফাসে; তিনটি বেলায় উপোশ করে থাকবে শুয়ে ঘাসে! (যদি) কুম্ড়োপটাশ ছোটে— সবাই যেন তড়বড়িয়ে জানলা বেয়ে ওঠে; হুঁকোর জলে আলতা গুলে লাগায় গালে ঠোঁটে; ভুলেও যেন আকাশ পানে তাকায় না কেউ মোটে! (যদি) কুম্ড়োপটাশ ডাকে— সবাই যেন শাম্লা এঁটে গামলা চড়ে থাকে; ছেঁচকি শাকের ঘন্ট বেটে মাথায় মলম মাখে; শক্ত ইঁটের তপ্ত ঝামা ঘষতে থাকে নাকে! তুচ্ছ ভেবে এ‐সব কথা করছে যারা হেলা, কুম্ড়োপটাশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা। দেখবে তখন কোন কথাটি কেমন করে ফলে, আমায় তখন দোষ দিও না, আগেই রাখি বলে। খুড়োর কল - সুকুমার রায় কল করেছেন আজবরকম চণ্ডীদাসের খুড়ো— সবাই শুনে সাবাস বলে পাড়ার ছেলে বুড়ো। খুড়োর যখন অল্প বয়স— বছর খানেক হবে— উঠল কেঁদে ‘গুংগা’ বলে ভীষন অট্টরবে। আর তো সবাই ‘মামা’ ‘গাগা’ আবোল তাবোল বকে, খুড়োর মুখে ‘গুংগা’ শুনে চম্কে গেল লোকে। বল্লে সবাই, “এই ছেলেটা বাঁচলে পরে তবে, বুদ্ধি জোরে এ সংসারে একটা কিছু হবে।” সেই খুড়ো আজ কল করেছেন আপন বুদ্ধি বলে, পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা যাবে দেড় ঘণ্টায় চলে। দেখে এলাম কলটি অতি সহজ এবং সোজা, ঘণ্টা পাঁচেক ঘাঁটলে পরে আপনি যাবে বোঝা। বলব কি আর কলের ফিকির, বলতে না পাই ভাষা, ঘাড়ের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে এক্কেবারে খাসা। সামনে তাহার খাদ্য ঝোলে যার যেরকম রুচি— মণ্ডা মিঠাই চপ্ কাট্লেট্ খাজা কিংবা লুচি। মন বলে তায় ‘খাব খাব’, মুখ চলে তায় খেতে, মুখের সঙ্গে খাবার ছোটে পাল্লা দিয়ে মেতে। এমনি করে লোভের টানে খাবার পানে চেয়ে, উত্সাহেতে হুঁস্ রবে না চলবে কেবল ধেয়ে। হেসে খেলে দু‐দশ যোজন চলবে বিনা ক্লেশে, খাবার গন্ধে পাগল হয়ে জিভের জলে ভেসে। সবাই বলে সমস্বরে ছেলে জোয়ান বুড়ো, অতুল কীর্তি রাখল ভবে চণ্ডীদাসের খুড়ো। কাতুকুতু বুড়ো - সুকুমার রায় আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার, কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেও না খবরদার! সর্বনেশে বৃদ্ধ সে ভাই যেও না তার বাড়ি— কাতুকুতুর কুলপি খেয়ে ছিঁড়বে পেটের নাড়ি। কোথায় বাড়ি কেউ জানে না, কোন্ সড়কের মোড়ে, একলা পেলে জোর ক’রে ভাই গল্প শোনায় প’ড়ে। বিদ্ঘুটে তার গল্পগুলো না জানি কোন দেশী, শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি। না আছে তার মুণ্ডু মাথা না আছে তার মানে, তবুও তোমায় হাসতে হবে তাকিয়ে বুড়োর পানে। কেবল যদি গল্প বলে তাও থাকা যায় সয়ে, গায়ের উপর সুড়সুড়ি দেয় লম্বা পালক লয়ে। কেবল বলে, “হোঃ হোঃ হোঃ, কেষ্টদাসের পিসি— বেচ্ত খালি কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম আর তিসি। ডিমগুলো সব লম্বা মতন, কুমড়োগুলো বাঁকা, কচুর গায়ে রঙ‐বেরঙের আল্পনা সব আঁকা। অষ্ট প্রহর গাইত পিসি আওয়াজ করে মিহি, ম্যাও ম্যাও ম্যাও বাকুম বাকুম ভৌ ভৌ ভৌ চীঁহি।” এই না বলে কুটুত্ ক’রে চিম্টি কাটে ঘাড়ে, খ্যাংরা মতন আঙুল দিয়ে খোঁচায় পাঁজর হাড়ে। তোমায় দিয়ে সুড়সুড়ি সে আপনি লুটোপুটি, যতক্ষণ না হাসবে তোমার কিচ্ছুতে নাই ছুটি। গোঁফ চুরি - সুকুমার রায় হেড আফিসের বড়বাবু লোকটি বড় শান্ত, তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনো জান্ত? দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে, একলা বসে ঝিম্ঝিমিয়ে হটাত্ গেলেন ক্ষেপে! আঁত্কে উঠে হাত‐পা ছুঁড়ে চোখটি ক’রে গোল! হটাত্ বলেন, “গেলুম গেলুম, আমায় ধ’রে তোল!” তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউ‐বা হাঁকে পুলিশ, কেউ‐বা বলে, “কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।” ব্যস্ত সবাই এদিক‐ওদিক করছে ঘোরাঘুরি— বাবু হাঁকেন, “ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি!” গোঁফ হারানো! আজব কথা! তাও কি হয় সত্যি? গোঁফ জোড়া তো তেমনি আছে, কমে নি এক রত্তি। সবাই তাঁরে বুঝিয়ে বলে, সামনে ধরে আয়না, মোটেও গোঁফ হয় নি চুরি, কক্ষনো তা হয় না। রেগে আগুন তেলে বেগুন, তেড়ে বলেন তিনি, “কারো কথার ধার ধারি নে, সব ব্যাটাকেই চিনি। নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা বিচ্ছিরি আর ময়লা, এমন গোঁফ তো রাখত জানি শ্যামবাবুদের গয়লা। এ গোঁফ যদি আমার বলিস করব তোদের জবাই”— এই না বলে জরিমানা কল্লেন তিনি সবায়। ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে দিলেন লিখে খাতায়— “কাউকে বেশি লাই দিতে নেই, সবাই চড়ে মাথায়। আফিসের এই বাঁদরগুলো, মাথায় খালি গোবর গোঁফ জোড়া যে কোথায় গেল কেউ রাখে না খবর। ইচ্ছে করে এই ব্যাটাদের গোঁফ ধরে খুব নাচি, মুখ্যুগুলোর মুণ্ডু ধরে কোদাল দিয়ে চাঁচি। গোঁফকে বলে তোমার আমার— গোঁফ কি কারো কেনা? গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।” বিদ্রোহী - কাজী নজরুল ইসলাম বল বীর - বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর! বল বীর - বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি' চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি' ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন "আরশ" ছেদিয়া উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর! মম ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর! বল বীর - আমি চির-উন্নত শির! আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর! আমি দুর্ব্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার! আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল! আমি মানি নাকো কোনো আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম, ভাসমান মাইন! আমি ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর! আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর! বল বীর - চির উন্নত মম শির! আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণী, আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণী! আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠুমকি' ছমকি' পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি' ফিং দিয়া দিই তিন দোল্! আমি চপলা-চপল হিন্দোল! আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা', করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা, আমি উদ্দাম, আমি ঝঞ্ঝা! আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর। আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর। বল বীর - আমি চির-উন্নত শির! আমি চির-দুরন্ত-দুর্ম্মদ, আমি দুর্দ্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দ্দম্ হ্যায়্ হর্দ্দম্ ভরপুর মদ। আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক, জমদগ্নি, আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি! আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান, আমি অবসান, নিশাবসান। আমি ইন্দ্রাণি-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য্য, মম এক হাতে-বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য্য। আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির। আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর। বল বীর - চির উন্নত মম শির। আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক! আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ! আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, আমি ইস্ত্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার, আমি পিনাক-পাণির ডমরু-ত্রিশূল, ধর্ম্মরাজের দন্ড, আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ-প্রচন্ড! আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য, আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব! আমি প্রাণ-খোলা-হাসি উল্লাস, - আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস, আমি মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস! আমি কভু প্রশান্ত, - কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী, আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্প-হারী! আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল, আমি উজ্জ্বল আমি প্রোজ্জ্বল, আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্ দোল! আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি, আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি। আমি উন্মন মন উদাসীর, আমি বিধাতার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর! আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের, আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের! আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়, চিত- চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর! আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক'রে দেখা অনুখন, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা'র কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্। আমি চির-শিশু, চির-কিশোর, আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর! আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাসী পূরবী হাওয়া, আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীনে গান গাওয়া! আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র রবি, আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! - আমি তুরিয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ! আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ! আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন, আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন! ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বর্গ-মর্ত্ত্য করতলে, তাজি বোরবাক্ আর উচ্চৈস্রবা বাহন আমার হিম্মত-হ্রেস্বা হেঁকে চলে! আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল, আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথর-কলরোল-কল-কোলাহল! আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ, আণি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা, সঞ্চরি' ভূমি-কম্প! ধরি বাসুকির ফনা জাপটি', - ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি'! আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল, আমি ধৃষ্ট আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল! আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী, মহা- সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্ ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম্ মম বাঁশরী তানে পাশরি' আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী। আমি রুষে উঠে' যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া, ভয়ে সপ্ত নরক হারিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া! আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া! আমি প্লাবন-বন্যা, কভু ধরণীরে করি বরণিয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা - আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা! আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি, আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি! আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী, আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি! আমি মৃণ্ময়, আমি চিন্ময়, আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়! আমি মানব দানব দেবতার ভয়, বিশ্বের আমি চির দুর্জ্জয়, জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য, আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্ত্য আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!! আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!! আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার, নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার! আমি হল বলরাম স্কন্ধে, আমি উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে। মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না - বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি আমি সেই দিন হব শান্ত! আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন, আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন! আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন! আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন! আমি চির-বিদ্রোহী বীর - আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির! কুলি-মজুর - কাজী নজরুল ইসলাম দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে! চোখ ফেটে এল জল, এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল? যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে, বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে। বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল! কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্? রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে, রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে, বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা। তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে, ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে! |